দুর্গাপুর,৫ই অক্টোঃ:এই বার বার্ষিক বোনাস ছাড়াই সেইল শ্রমিকদের কাটল শারোদৎসব।
সাম্প্রতিক কালের মধ্যে এই ঘটনা সেইল – আরআইএনএল এর ক্ষেত্রে ঘটে নি । অবসরপ্রাপ্ত
শ্রমিকরা যারা ১৯৭০ এর দশকে সেইলে কর্মরত ছিলেন,তারা একথা স্বগর্বের সাথে স্মরন করেন
যে জরুরী অবস্হার কালো দিনেও বার্ষিক বোনাস আদায় করা সম্ভব হয়েছিল । অথচ স্বাধীনতার
৭৫-তম বার্ষিকিতে দেশের কাছে অনবদ্য উপহার তুলে দিয়েছেন কেন্দ্রিয় সরকারের ইস্পাত মন্ত্রকের
অধীনস্হ “মহারত্ন” স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া
( সেইল ) এর স্হায়ী ও ঠিকা শ্রমিক – কর্মচারিবৃন্দ। ২০২১-২২ আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ব
ইস্পাত উৎপাদনকারী সংস্হা স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ( সেইল ) এর ৫৫ বছরের ইতিহাসে সর্বকালীন সেরা উৎপাদন, উৎপাদনশীলতা,বিক্রি ও সর্বোচ্চ মুনাফা
( কর দেওয়ার আগে ও পরে উভয় ক্ষেত্রেই ) হয়েছে। কাঁচামালের দামবৃদ্ধি,বিশ্ব জোড়া প্রতিযোগিতা,রেকর্ড
সংখ্যায় শ্রমিক হ্রাস,কোভিড অতিমারী, বেতন-চুক্তির জন্য হতাশাজনক মৌ-চুক্তি ,বিশাখাপত্তনমে
আরআইএনএল কারখানা কে বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোদি সরকারের চেষ্টার বিরুদ্ধে
একটানা প্রায় ৬০০ দিনের ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা ও অ্যালয়
স্টিল প্ল্যান্ট এর আধুনিকীকরন ও সম্প্রসারন না হওয়া এবং সর্বোপরি কেন্দ্রের
মোদি সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্হা বিরোধী করাল নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে এই মহা
সাফল্য এসেছে।
করোনার অতিমারীর
মধ্যে মৃত্যু এসে শতাধিক শ্রমিকের জীবন ছিনিয়ে নেয়। ২০২১-২২ আর্থিক বছরে সেইল এর আর্থিক
লেনদেন এর পরিমান বার্ষিক ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ফলে , সেইল ভারতের এই রকম মুষ্টিমেয়
কিছু কোম্পানীর “এলিট গ্রুপে “ জায়গা করে
নিয়েছে । নিট মুনাফার পরিমান ১২০১৫ কোটি টাকা
ছোঁয়,যা সেইলের ইতিহাসে সর্বকালীন রেকর্ড । বিগত বছরের তুলনায় এই মুনাফার পরিমান তিন
গুন এর বেশী বৃদ্ধি পায় ।
কিন্তু সেইলের
৫৫ বছরের ইতিহাসে এই আনন্দঘন মুহুর্তে ,এই সাফ্যলের অন্যতম কাণ্ডারী ইস্পাত শ্রমিকদের
জীবনে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া । কারন শারোদৎসব এর প্রাক্কালে বার্ষিক বোনাস হয় নি
। এর ফলে ,রাজ্যের আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল সহ সারা দেশে ভিলাই,বোকারো,রাউরকেলা,সালেম, বিশাখাপত্তনমে,চন্দ্রপুরার মত ইস্পাতনগরী
এবং কিরিবুরু,মেঘাতাবুরু,বোলানির মত খনি শহরে দুর্গা পুজোর বাজার মার খেয়েছে,বহু সাধারন
মানুষের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্হ হয়েছে ।কারন ইস্পাত শ্রমিক – কর্মচারিরা বার্ষিক বোনাসের টাকায় সম্বছরের জামা-কাপড় সহ অন্যান্য জিনিসপত্র
এই সময়ে বেশী কেনাকাটা করে থাকেন ।
শ্রমিকদের বার্ষিক বোনাস,যা ‘পুজো বোনাস’ নামে শিল্পাঞ্চলে সমাধিক পরিচিত, গত ২৪শে
সেপ্টেঃ (শনিবার) দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সেইল-আরআইএনএল এর কর্তৃপক্ষের সাথে ইউনিয়ন গুলির
সাথে বার্ষিক বোনাস সংক্রান্ত আলোচনা, কর্তৃপক্ষের একঁগুয়েমীর জন্য ভেস্তে যায়। ফলে
শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বিষ্ফোরিত হয় । দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা সহ
সেইলের সর্বত্র শ্রমিকরা প্রবল বিক্ষোভ আন্দোলন সামিল হয়েছেন।দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায়
সিআইটিইউ সহ ৭টি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ আহ্বানে ইস্পাত শ্রমিকরা উৎপাদন বিঘ্নিত
না করেই দফায় দফায় ৫ দিন শান্তিপূর্ন ও গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দেখান।এরই মধ্যে
গত ১লা অক্টোঃ সেইল বোর্ডের এক ডাইরেক্টরের দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার পরিদর্শনের কারনে,ঐ
দিন সৌজন্যবশতঃ ৭টি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচী বন্ধ থাকে।কিন্তু উৎসব
চলাকালিন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ন ও গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে
বিক্ষোভ দেখানোর জন্য চার শ্রমিক নেতা যথাক্রমে হিন্দুস্হান স্টিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন
(সিআইটিইউ ) এর দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা শাখার সম্পাদকমণ্ডলীর আহ্বায়ক সীমান্ত চ্যাটার্জী,কমিটি
সদস্য রানা মজুমদার(সিআইটিইউ ),গৌতম চট্টোপাধ্যায় ( এইচএমএস ) ও মানস চট্টোপাধ্যায়
(বিএমএস ) কে শোকজ নোটিশ -চার্জশীট ধরিয়ে দেওয়ায়
উত্তেজক পরিস্হিতির সৃষ্টি হয়েছে দুর্গাপুর
ইস্পাত কারখানা সহ সেইলের সর্বত্র।এই পরিস্হিতে, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার সিআইটিইউ সহ ৭টি সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ আলোচনায় বসে অবিলম্বে
শান্তিপূর্ন ও গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য চার শ্রমিক নেতা কে পাঠানো
শোকজ নোটিশ –চার্জশীট প্রত্যাহারের দাবি জানানোর পাশাপাশি সম্মানজনক বোনাসের দাবিতে
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে হিন্দুস্হান স্টিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (সিআইটিইউ ) এর
পক্ষে বিশ্বরূপ ব্যানার্জি জানিয়েছেন । তিনি আরো জানিয়েছেন যে ঐ সভায় সিআইটিইউ সহ ৭টি
সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আগামী ৬ই অক্টোঃ দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার ইডি (
ওয়ার্কর্স) এর দপ্তরের সামনে যৌথ শ্রমিক সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে।একই দাবিতে,যথাক্রমে
৭ ও ৮ই অক্টোঃ সেইলের সর্বত্র শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখাবেন বলে স্টিল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন
অফ ইন্ডিয়া ( সিআইটিইউ )-এর পক্ষ থেকে ললিত মিশ্র জানিয়েছেন। এদিকে,এই বিষয়ে সেইলের
এর চেয়ারম্যান কে লেখা চিঠিতে সিআইটিইউ এর সর্বভারতীয় সম্পাদক ও স্টিল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন
অফ ইন্ডিয়া ( সিআইটিইউ )-এর সভাপতি তপন সেন,শিল্পে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে দুর্গাপুর
ইস্পাত কারখানার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইউনিয়নগুলির যৌথ শান্তিপূর্ন ও গনতান্ত্রিক
পদ্ধতিতে বিক্ষোভ দেখানোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্হা থেকে বিরত করা ও অবিলম্বে
চার শ্রমিক নেতা কে পাঠানো শোকজ নোটিশ –চার্জশীট প্রত্যাহারের জন্য সেইলের এর চেয়ারম্যানের
হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে,ঠিকা শ্রমিকদের বোনাসের জন্য
সেইলের কর্তৃপক্ষ খালি সার্কুলার দিয়ে দায় সেরেছে বলে সিআইটিইউ এর পক্ষ থেকে অভিযোগ
করা হয়েছে ।
বোনসের বিষয়ে
ইউনিয়নদের চাপে সেইল কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারী করলেও,প্রত্যেক ঠিকা শ্রমিকের বোনাস
নিশ্চিত করতে ঠিকাদারদের ওপরে নজরদারির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না।অতীত অভিজ্ঞতায়
দেখা গেছে যে বৃহৎ অংশের ঠিকা শ্রমিকের বোনাস হয় না । ইউসিডব্লুইউ( সিআইটিইউ )-এর পক্ষে নিমাই
ঘোষ জানিয়েছেন যে এবারও দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় মাত্র ৪০% ঠিকা শ্রমিকের ‘ বোনাস অ্যাডভান্স ‘ মিলেছে মাত্র
। বাকি ঠিকা শ্রমিকরা গড়ে ২৫০-৩০০ টাকা ঠিকাদারদের থেকে কেবল ‘বখশিস’ পেয়েছেন। সেইলের
সর্বত্র ঠিকা শ্রমিকরা এই চরম বঞ্চনার শিকার,কোথাও কোথাও অবস্হা আরো শোচনীয় । তাই ঠিকা
শ্রমিকদের আন্দোলনও জারি থাকবে ।
No comments:
Post a Comment