Wednesday 7 January 2015

শিক্ষা যখন বাজারী পণ্য , তখন করা হয় দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পিত ধ্বংসসাধন ।

                                                                

গত শতাব্দীর ৫০ এর দশক থেকে দুর্গাপুরে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক সরকারী শিল্পসংস্হা যার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পসংস্হা দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা ( সংক্ষেপে ডিএসপি )। ১৬টি গ্রামকে রাজ্য সরকার অধিগ্রহন করে তুলে দেয় ডিএসপি তৈরীর সময়ে । ১৯৬০ সালে তৈরী হয় ডিএসপির প্রথম স্কুল এ’জোন মাল্টিপারপাস ( কো –এড ) । এরপরে একে একে তৈরী হয় ১০টি হাইস্কুল , ১৯টি প্রাইমারী স্কুল সহ  প্রাইমারী স্কুলের সহযোগী আরও ১০টি নার্সারী স্কুল । ৭০এর দশকে ডিএসপির স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বছরে ৩০,০০০ হাজার ছাড়িয়ে যায় । হাইস্কুল,প্রাইমারী ও প্রাইমারী স্কুলের সহযোগী নার্সারী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সর্বোচ্চ সংখ্যা ১৬০০ ছাড়িয়েছিল ।সুপরিকল্পিত স্কুল বিল্ডিং , বড় ও আরামদায়ক ক্লাসরুম – চেয়ার –বেঞ্চি-টেবিল , অডিটোরিয়াম , লাইব্রেরী,ল্যাবরেটরি , বিশাল খেলার মাঠ ও অপর্যাপ্ত খেলার সরঞ্জাম , গান-বাজনার সরঞ্জাম , ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রকমারী টিফিন , নিবেদিত শিক্ষককুল – এক কথায় স্বাধীন ভারতের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্হা গড়ে তোলার জন্য ঠিক যেমনটি দাবী ছিল , তার অধিকাংশই চালু ছিল ডিএসপির স্কুলে । দেশের শিল্প মানচিত্রে যেমন সামনের সারিতে ডিএসপি  উঠে আসে , ঠিক তেমনি রাজ্যের শিক্ষাজগৎে উল্ল্যেখযোগ্য জায়গা করে নেয় ডিএসপির স্কুল । বিশেষ করে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম ১০জনের তালিকায়  যখন কলকাতার কিছু নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া রমরমা ছিল তখন জেলার স্কুল হিসেবে ডিএসপির এ’জোন বয়েজ মাল্টিপারপাস , কাশীরাম ও শিবাজী বয়েজ , বি’জোন গার্লস মাল্টিপারপাসের মতন স্কুলগুলি থেকে প্রায় নিয়মিত সেই মেধা তালিকায় জায়গা করে নিত ।বর্ধমান জেলা তো বটেই , কলকাতা সহ ভারতের নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিএসপির স্কুলের থেকে পাশ করা বহু ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি বিপুল সংখ্যায় ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত এবং আজও করছে । তবে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা কমে আসার সাথে সাথে এখন সেই সংখ্যা ক্রমশঃ কমে আসছে । ডিএসপির স্কুলে ডিএসপির শ্রমিক পরিবার সহ বিভিন্ন সরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্হা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ( গ্রামসহ ) ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসতো । রাজ্যের কাছে জমি সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহন এবং আইনী ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্হা ডিএসপির শ্রমিক পরিবার সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারে ব্রতী হয়েছিল । এই প্রয়াসের অসামান্য ফল হল ডিএসপির স্কুলের থেকে পাশ করে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী আজ দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রতিষ্ঠিত । ইস্পাত তৈরির সাথে পশ্চাদপদ অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও মানবসম্পদ তৈরী করার এই অসমান্য প্রয়াসের তাৎপর্য উপলব্ধি অথবা বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা এখনও হয় নি । কিন্তু ভবিষ্যৎকে তা করতেই হবে । কিন্তু , ৭০ এর মাঝামাঝি থেকে বিশেষ করে জরুরী অবস্হার সময় থেকে ডিএসপি কর্তৃপক্ষ স্কুলের থেকে একে একে সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করতে থাকে । ডিএসপি এই সময়েই আইনের পরোয়া না করে ইস্পাতনগরীতে বেসরকারী স্কুল তৈরী করে বিপুল মুনাফার রাস্তা খুলে দেওয়ার করে দেয় । ১৯৮৪ রাজীব গান্ধী সরকারের সময় থেকে পরবর্তি তিন দশক ধরে  ডিএসপির শিক্ষা-বাজেট কমতে শুরু করে , নতুন শিক্ষক নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয় যায় , শ্রমিক পরিবারের বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির সুযোগ ক্রমশঃ কেড়ে নেওয়া হয় । এককথায় , ডিএসপির স্কুল গুলিকে গুটিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়ে যায় । তিন দশক ধরে এই প্রক্রিয়া চলার মধ্য দিয়ে আজ প্রাইমারী স্কুলের সংখ্যা হয়ছে ১টি , হাইস্কুল ৭টি ও ইংরাজী মাধ্যমের ( সিবিএসসি ) স্কুল ১টি । সামনের বছরে আরও ২ টি ( আকবর রোড গার্লস ও বি’জোন বয়েস মাল্টিপারপাস ) হাইস্কুলে বন্ধের নির্দেশিকা জারী করেছে ডিএসপি । স্কুলের ফী বৃদ্ধি একধাক্কায় ৮২ গুন বৃদ্ধিরও নির্দেশ জারী করেছে ডিএসপি ।  এই সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে , বেড়েছে ছাত্র সংখ্যা । বামফ্রন্টের সময়ে ইস্পাতনগরীর সংলগ্ন অঞ্চলে স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও পর্যাপ্ত নয় ।গত ৫৫ বছর ধরে , শ্রমিক পরিবার ছাড়াও এই অঞ্চলের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ছিল ডিএসপির স্কুল । আজ মোদী সরকার সেইলের শেয়ার বেচে কেবল দেশের ইস্পাত শিল্পকে বেচে দিচ্ছে তাই নয় , বেচে দিচ্ছে জনগনের সম্পত্তি । তারই রেশ ধরে রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট এবং পাব্লিক সেক্টরের আইনী দায়বদ্ধতাকে অমান্য করে কর্তৃপক্ষ ডিএসপির স্কুলকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ইস্পাতনগরীতে বেসরকারী স্কুলের মুনাফা করে দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে  । তৃণমূল সরকার সব জেনেও নিশ্চুপ । প্রতিবাদে পথে নেমেছে অভিভাবক , ছাত্র-ছাত্রী , শিক্ষক-শিক্ষিকারা । পাশে দাঁড়িয়েছে হিন্দুস্হান স্টিল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ( সিআইটিইউ ) । 

No comments:

Post a Comment